কবিতা ও পদ্য একই বিষয় নয় (সম্পূর্ণ)

লিখেছেন লিখেছেন আতিকুর রহমান ফরায়েজী ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৫৪:০৭ সকাল



সাহিত্যে ভাব প্রকাশের অন্যতম দু’টি মাধ্যম হচ্ছে ‘গদ্য’ ও ‘পদ্য’।গদ্যকে বলা হয় Prose এবং পদ্যকে বলা হয় Verse। একই কথা আমরা গদ্যে বলতে পারি। পদ্য মাধ্যমে বললেই যে তা কবিতা হবে- এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ কবিতা ও পদ্য একই বিষয় নয়। কবিতা সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণ নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতির মতো একটি পৃথক সাহিত্য প্রকরণ। ইংরেজিতে কবিতা বলতে আমরা বুঝি Poetry। কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তার প্রকৃতিগত কিছু বৈশিষ্ট দরকার- যেগুলো থাকলেই আমরা তাকে কবিতা বলতে পারবো। অথচ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট না জানার কারণে বহুজন কবিতা ও পদ্যকে সমার্থক মনে করেন। এর অন্যতম একটা কারণ হতে পারে, দীর্ঘদিন পদ্যই ছিল আমাদের সাহিত্যের মাধ্যম। তার ফলে রাধা-কৃষ্ণের লীলা থেকে শুরু করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বের মতো দুরূহ গ্রন্থও লেখা হয়েছে পদ্য মাধ্যমেই। কবিতায় ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের ব্যবহার করা বা না করা, পদ্য ও কবিতার মধ্যে অন্যতম একটি পার্থক- এমন কথাও অনেকে বলেন।

কাব্যরূপ ও আঙ্গিকের বিচারে ছন্দের প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া চলে না। তার জন্মলগ্ন থেকে কবিতা দীর্ঘকাল অন্ত্যমিলসম্পন্ন, নিরুপিত ছন্দের অধীনের ছিল। `Verse libre’ বা `free verse’ বা গদ্য কবিতার মুক্তিমন্ত্র উচ্চারণেও কবিতার সেই অধীনতা দূর হয়ে গেছে- এমন নয়। ছন্দ বলতে অন্ত্যমিলসম্পন্নতাকে বোঝাচ্ছি না। ছন্দের দোলা, মিল থাক বা না থাক, কাব্যিক প্রকারান্তরে বলা যেতে পারে এক ধরনের ছন্দ- স্পন্দ বা Rhythm এবং কবিরা প্রায় সকলেই এই সঙ্গীতধর্ম বজায় রেখে থাকেন। কবি যখন একটি বিশেষ আবেগকে বাণীরূপ দান করেন, তখন কোনও একটি ছন্দের স্পন্দিত রূপবন্ধনেই তা প্রকাশিক হয়। এই সমিল, সুষম ছন্দে বিধৃত রূপবন্ধ কবিতার পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়। অনেকেই মত দিয়েছেন ‘কবিতা’ ও ‘ভার্স’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি ব্যাপার। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ‘গদ্য ও ‘কবিতা’র ভাষার মধ্যে কোনো বিভাজন মানতে চাননি এবং এমিলি ডিকশন (Emily Diction 1830-1886) একে নিছক আলঙ্কারিক মাধুর্যের জন্যই প্রয়োজনীয় বলে মত দিয়েছেন। কোলরিজ (Samuel Taylor Coleridge 1772-1834) বিষয়টাকে দেখেছেন এভাবে- The opposite of poetry is not prose but science; the opposite of prose is not poetry but verse.” অর্থাৎ- ‘কবিতার বিপরীত গদ্য নয়- কিন্তু বিজ্ঞান; গদ্যের বিপরীত কবিতা নয়- কিন্তু পদ্য।’

তার কথামতো শ্রেষ্ট কবিতা ছন্দে বাণীবদ্ধ নাও হতে পারে-~Poetry of the highest kind may exits without metre. “রবীণ্দ্রনাথ ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ভূমিকায় বলেছেন, “পদ্যকাব্যে ভাষার ও প্রকাশরীতিতে যে একটা সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে, তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস এবং সেইদিকে লক্ষ্য রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি।” ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এবং রবীন্দ্রনাথ এসব কথা বললেও ওয়ার্ডওয়ার্থ যে শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো পদ্য মাধ্যমেই রচনা করেছেন, তা আমরা নিশ্চয় মনে করতে পারবো। গদ্য পদ্যের ‘ভাসুর—ভাদ্রবধু’ সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ মানেন না, এমন কথাও বলেছেন এবং ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘কাব্যের অধিকার’ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন- এও তার দাবি। তা সত্ত্বেও যখন পরবর্তী কাব্যপ্রয়াসে পদ্যছন্দকে তিনি ফিরিয়ে আনেন এবং ‘আফ্রিকা’-জাতীয় বেশ কিছু কবিতায় বারবার আঙ্গিক পরিবর্তন করেন, তখন বোঝা যায়- একটা কোনও অস্বস্তি তাঁকে বিচলিত করছে। আমরা এখন বুঝি- মিল বা পর্বের মাত্রাসমকত্ব ত্যাগ করলেও ছন্দস্পন্দ বা Rhythm রবীন্দ্রনাথ ত্যাগ করতে পারে না, ইচ্ছে করলেও না।

মিলযুক্ত ছন্দে ধৃত পদ্যের বিন্যাস সাঙ্গীতিক গড়নের পক্ষে সুখপ্রদ হলেও পদ্যমাধ্যমে কবিতা রচনা অসম্ভ বা অসমীচীন মোটেও নয়। ‘ভার্সৎ মানেই কবিতা নয়। ‘গদ্য’ও কবিতার মাধ্যমে হতে পারে, যদি তাতে থাকে ছন্দস্পন্দ, থাকে তাল ও লয়ের সৌন্র‌্যসুষমা- যা কবিতার আবেগী, কল্পনাশ্রয়ী প্রকাশের উপযোগী হয়। অবশ্যই সে গদ্য বিজ্ঞান বা তর্কশাস্ত্রের বস্তুনিষ্ঠ গদ্যের থেকে একেবারেই আলাদা। জীবনানন্দ দাশের একটি লেখা পড়লেই বোঝা যাবে, কবিতার সীমান্ত থেকে এটা কি খুব বেশি দূরে?

সোমেনও বললে, মনে পড়ে একদিন বকমোহনার নদীর পাড়ে ভাঁটশ্যাওড়া

জিউলি ময়নাকাঁটা আলোকলতা জঙ্গলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম; বাড়ি

তোমাদের আধ ক্রোশ দূর সেখান থেকে; তুমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলে, “খুব পারব

চিনে যেতে- কতবার গিয়েছি!”- কিন্তু একবারও যাওনি; আম কাঁঠাল বাঁশের

জঙ্গলে হারিয়ে গেলে।

ওপরে উদ্ধৃত অংশটি একটু মনযোগ দিয়ে পেড়লে পদ্য (verse) কবিতার অবশ্যম্ভাবী মাধ্যম বা কাঠামো- এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান সময়ে গদ্যমাধ্যমে কবিতা লেখার প্রবণতা ক্রমবিস্তার লাভ করছে, কবিতা লেখার জন্য কবিতার নিদিষ্ট শিল্পরূপ জানতে হবে- এর কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ছন্দের মিলই কখনো কবিতা হতে পারে না; কবিতা যখন আবেগ-অনুভূতিতে-কল্পনায়-চেতনায় এক বাচনিক রূপ হয়ে ফুটে উঠবে, ছন্দ তখন তার অস্তিত্বের অঙ্গীভূত হয়ে থাকবে।

বিষয়: সাহিত্য

১০৩১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

274202
১৪ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১১:১৫
কাহাফ লিখেছেন :
আমরা সাধারণ পাঠকদেরও এমন ধারণা ছিল।
ধন্যবাদ আপনাকে- তথ্য বহুল অসাধারণ নান্দনিক লেখনীর জন্যে। Rose
১৪ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:১২
218121
আতিকুর রহমান ফরায়েজী লিখেছেন : এতদিন ধারণা ছিল, আর আজ তা প্রমাণিত হলো। ধন্যবাদ এমন গবেষণাপূর্ণ ধারণা বহন করার জন্য।
274206
১৪ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ১১:৩০
জোনাকি লিখেছেন : ভাল্লাগ্লো। আমাদের ব্লগেতো এমন লেখা আসেইনা।
আরো লিখুন।
১৪ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:১২
218120
আতিকুর রহমান ফরায়েজী লিখেছেন : এ ধরনের লেখা প্রকাশ করার জন্য অনেক পড়াশোনা করার প্রয়োজন, সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু; আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে অলস, তাই এধরনের পোস্ট দেওয়াটা আমাদের জন্য সো টাফ। তারপরও চেষ্টা করবো এমন কিছু লেখা আপনাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য। ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File